শিরোনাম

South east bank ad

মুমিনের জীবনে ‘আল্লাহু আকবর’-এর মাহাত্ম্য

 প্রকাশ: ০২ মার্চ ২০২২, ১২:০০ পূর্বাহ্ন   |   ইসলাম ও জীবন

বিডিএফএন টোয়েন্টিফোর.কম

বরকতময় এক মহান কালেমা হলো আল্লাহু আকবার ধ্বনি। যে ধ্বনির মধুরতায় মুখরিত পুরো বিশ্বের অলি-গলি। সেই ধ্বনির প্রভাব বলয়ে মুমিনের চিত্ত হয় প্রশান্ত। ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলেন, আল্লাহু আকবার দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ বাক্য। (তাফসিরে কুরতুবি, সুরা ইসরা, আয়াত : ১১১)

এই ধ্বনি এই বার্তা প্রকাশ করে যে, আল্লাহ তাআলা সবচেয়ে বড়। তার চেয়ে বড় কেউ নেই। শক্তি-সামর্থের সম্মান সবদিক থেকেই মহান আল্লাহ সবার ঊর্ধ্বে। আল্লাহু আকবার এমন এক মহান শব্দ যে ধ্বনি শুনে শয়তান পালায়ন করে, লজ্জিত হয়, নিন্দিত হয়।

মহান আল্লাহর বড়ত্ব ও মহিমা বর্ণনার সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম শব্দ এই আল্লাহু আকবার ধ্বনি। এই শব্দ উচ্চারণের মাধ্যমে মুমিন বান্দা তার প্রভুর প্রতি বিশ্বাসের প্রকাশ ঘটান এবং রবের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তোলেন। যে মুমিনের অন্তরে তাকবিরের মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব যত বেশি হবে, তার ঈমানের প্রভাব তত বেশি প্রতিফলিত হবে। তাই ইসলামী শরিয়তে আজান ও নামাজের পাশাপাশি বছরের বিভিন্ন সময় ও জীবনঘনিষ্ঠ নানা অনুষঙ্গে তাকবির পাঠের বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে।

আল্লাহু আকবার বলার কিছু উপকারি দিক-

আল্লাহু আকবার বলার কারণে শয়তান দূর হয়

তাকবির তথা আল্লাহু আকবার হলো এমন একটি বাক্য, যা কাফির এবং তাদের নেতৃবৃন্দ ও ইবলিসের মনে প্রচণ্ড কম্পন সৃষ্টি করে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, শয়তান যখন সালাতের আজান তথা (আল্লাহু আকবারের আওয়াজ) শুনতে পায়, তখন বায়ু ছাড়তে ছাড়তে পালাতে থাকে, যেন আজানের শব্দ তার কানে পৌঁছতে না পারে। মুয়াজ্জিন যখন আজান শেষ করে তখন সে ফিরে এসে (সালাত আদায়কারীর) সংশয়-সন্দেহ সৃষ্টি করতে থাকে। সে পুনরায় যখন ইকামাত শুনতে পায়, আবার চলে যায় যেন এর শব্দ তার কানে না যেতে পারে। যখন ইকামাত শেষ হয় তখন সে ফিরে এসে (সালাত আদায়কারীদের অন্তরে) সংশয়-সন্দেহ সৃষ্টি করতে থাকে। (মুসলিম, হাদিস : ৭৪২ )

যুদ্ধের ময়দানে আল্লাহু আকবারের প্রভাব

এক বর্ণনায় বসনিয়ার যুদ্ধে মুজাহিদদের অবস্থানের কথা এভাবে তুলে ধরা হয়েছে, যখন মুজাহিদরা ময়দানে আসতেন এবং আল্লাহু আকবার বলে ধ্বনি উচ্চারণ করতেন। আল্লাহর শপথ! তখন বিপুল পরিমাণে যুদ্ধাস্ত্র থাকা সত্ত্বেও সে অঞ্চলে একটা মুশরিক পুরুষ পাওয়া যেত না।

সহিহ বুখারির বর্ণনায় আছে, আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) অতি সকালে খায়বার প্রান্তরে প্রবেশ করেন। সে সময়ে ইহুদিরা কাঁধে কোদাল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। তারা যখন তাকে দেখতে পেল, তখন বলতে লাগল, মুহাম্মদ সেনাদলসহ আগমন করেছে, মুহাম্মদ সেনাদলসহ আগমন করেছে ফলে তারা দুর্গে ঢুকে পড়ল। তখন আল্লাহর রাসুল (সা.) তার উভয় হাত তুলে বললেন, ‘আল্লাহু আকবর, খায়বার ধ্বংস হোক।’ (বুখারি, হাদিস : ২৯৯১)

খুশির সংবাদে আল্লাহু আকবার বলা সুন্নত

যে কোনো বৈধ খুশির সংবাদ শুনে আল্লাহু আকবার বলা সুন্নত। সাহাবায়ে কেরাম খুশির সংবাদ শুনে আল্লাহু আকবার বলতেন। সহিহ বুখারির এক দীর্ঘ বর্ণনায় এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) একবার সাহাবাদের বলেন, আমি আশা করি, তোমরা সব জান্নাতবাসীর এক-তৃতীয়াংশ হবে। বর্ণনাকারী আবু সাঈদ (রা.) বলেন, তখন আমরা এ সংবাদ শুনে আবার আল্লাহু আকবার বলে তাকবির দিলাম। তিনি আবার বলেন, আমি আশা করি, তোমরা সব জান্নাতির অর্ধেক হবে। এ কথা শুনে আমরা আবারও আল্লাহু আকবার বলে তাকবির দিলাম। তিনি বলেন, তোমরা তো অন্য মানুষের তুলনায় এমন, যেমন সাদা ষাঁড়ের দেহে কয়েকটি কালো পশম অথবা কালো ষাঁড়ের শরীরে কয়েকটি সাদা পশম। (বুখারি, হাদিস : ৩৩৪৮)

আগুন নেভানোর ক্ষেত্রে আল্লাহু আকবার সাহায্য করে

হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘যখন তোমরা কোনো জায়গায় আগুন লেগে গেছে দেখো, তখন আল্লাহ আকবার বলতে থাকো। কেননা তাকবির আগুন নেভাতে সহায়ক।’ আরেক বর্ণনায় এসেছে, নবীজি (সা.) বলেছেন, তোমরা আগুন নেভাতে তাকবিরের সাহায্য নাও। (মাকাসিদুল হাসানা, হাদিস : ৬৩)

আল্লাহু আকবার বলার মাধ্যমে অহংকার দূর হয়

মানুষের জীবন ধ্বংসকারী মারাত্মক একটি স্বভাব হলো অহংকার। এই স্বভাবের লোকেরা দুনিয়া ও আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠান, সমাজ, সংগঠন, রাষ্ট্র এমনকি নিজ পরিবারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই আল্লাহ তাআলা কোরআন মাজিদে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা দিয়ে বলেন, ‘পৃথিবীতে উদ্ধতভাবে বিচরণ কোরো না। কেননা তুমি তো কখনোই পদভারে পৃথিবী বিদীর্ণ করতে পারবে না। আর উচ্চতায় কখনো পর্বত সমান হতে পারবে না।’ (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৩৭)

এই স্বভাব থেকে বাঁচতে প্রয়োজন খুব বেশি পরিমাণে তাকবির বা আল্লাহু আকবার পাঠ করা। কারণ, মুমিনের অন্তরে যখন আল্লাহ সবচেয়ে বড় এ বিশ্বাস দৃঢ়ভাবে স্থাপন হবে, তখন সব অহংকার, হিংসা-বিদ্বেষ থেকে অন্তর পবিত্রতা লাভ করবে। আর এটিই আল্লাহু আকবারের সবচেয়ে বড় প্রভাব।

অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে

যখন কোনো মুমিন বান্দা মনের গভীর থেকে আল্লাহর মাহাত্ম্য ঘোষণা করবে, তাকবিরের গুরুত্ব অনুধাবন করবে, সে গুনাহ ও সীমা লঙ্ঘন থেকে বাঁচতে পারবে। কারণ যে মুমিনের অন্তরে সত্যিকারার্থে আল্লাহর সম্মান ও ভয় থাকে, সে কখনো গুনাহে লিপ্ত হতে পারে না; বরং তাকবিরের মর্মার্থ না বোঝার কারণেই মূলত মানুষ গুনাহের দিকে ধাবিত হয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর কেউ আল্লাহর শাআইর (নিদর্শন)-কে সম্মান করলে এটা তো অন্তরস্থ তাকওয়া থেকেই অর্জিত হয়।’ (সুরা হজ, আয়াত : ৩২)

আর আল্লাহু আকবার ‘শাআইরে ইসলাম’-এর অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং যে ব্যক্তি এর মর্যাদা রক্ষা করবে সে সব ধরনের গুনাহ থেকে বাঁচতে পারবে।

শরিয়তের যেসব জায়গায় তাকবির বলতে হয়

নামাজে তাকবির : আজানের মধ্যে তাকবির বলতে হয়। ঈমানের পর সবচেয়ে যে হুকুম নামাজ। সেই নামাজ শুরু হয় তাকবির তথা আল্লাহু আকবর দিয়ে। তেমনি নবজাতকের কানে তাকবির বলা। মৃত ব্যক্তির জন্য জানাজায় তাকবির বলা ইসলামের বিধান।

চাঁদ দেখার সময় তাকবির : প্রতি মাসে যখন আকাশে নতুন চাঁদ উদিত হয়, তখন তা দেখে তাকবির বলা সুন্নত। নবী (সা.) নতুন চাঁদ দেখার পর বলতেন—(উচ্চারণ) ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহুম্মা আহিল্লাহু আলাইনা বিল-য়ুমনি ওয়াল ঈমানি, ওয়াসসালামাতি ওয়াল ইসলামী, রাব্বি ওয়া রাব্বুকাল্লাহ। ’ অর্থ : ‘আল্লাহ মহান; হে আল্লাহ, আমাদের জন্য চাঁদটিকে বরকতময় (নিরাপদ), ঈমান, নিরাপত্তা ও শান্তির বাহন করে উদিত করুন। হে নতুন চাঁদ, আল্লাহ তাআলা আমারো প্রভু, তোমারো প্রভু। ’ (সুনানে দারিমি, হাদিস : ১৭২৯)

হজের সময় : মুসলমানদের পবিত্র তীর্থস্থান বায়তুল্লাহ হজ। সেই পবিত্র ঘর জিয়ারতকালে উচ্চ স্বরে তাকবির বলতে হয়। কঙ্কর নিক্ষেপ করার সময়, আরোহণ করা, নিচে অবতরণ করা, তাওয়াফ করাসহ এ ধরনের সব জায়গাতেই আল্লাহু আকবার বলতে হয়। রাসুল (সা.) বলেন, জিলহজের এই ১০ দিন আল্লাহর কাছে তাকবিরের চেয়ে আর বড় কোনো আমল নেই। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৬১৫৪)

ঈদের তাকবির : রমজান ও কোরবানির ঈদের সময় তাকবির বলা। আল্লাহ বলেন, আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ চান এবং তোমাদের জন্য কষ্ট চান না। আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূর্ণ করো এবং তিনি তোমাদের যে হিদায়াত দিয়েছেন সে জন্য তোমরা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করো এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৫)

সফরে তাকবির বলা : রাসুল (সা.) যখন বাহনে আরোহণ করতেন, তখন তিনি আল্লাহু আকবার বলতেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) কোথাও সফরের উদ্দেশে তার উটে আরোহণের সময় তিনবার ‘আল্লাহু আকবার’ (আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ) বলতেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৩১৬৬)

পশু জবাইয়ের সময় : কোনো প্রাণী জবাইয়ের সময় তাকবির বলা। আনাস (রা.) বলেন, নবী (সা.) দুই শিংবিশিষ্ট সাদা-কালো ধুসর রঙের দুটি দুম্বা স্বহস্তে জবাই করেন। (জবাই করার সময়) তিনি ‘বিসমিল্লাহ ও আল্লাহু আকবার’ বলেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৪৯৮১)

তাকবিরের খোলে আসমানের দুয়ার : একবার রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে নামাজ আদায়কালে এক ব্যক্তি বলে উঠল, ‘আল্লাহু আকবার কাবিরা ওয়াল হামদুলিল্লাহ কাসিরা ওয়া সুবহানাল্লাহি বুকরাতান ওয়া আসিলা’ (অর্থ : আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ, সবচেয়ে বড়। সব প্রশংসা আল্লাহর। আর সকাল ও সন্ধ্যায় তারই পবিত্রতা বর্ণনা করতে হবে)। নামাজ শেষে রাসুল (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন, এ কথাগুলো কে বলল? সবার মধ্যে থেকে জনৈক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আমি ওই কথাগুলো বলেছি। তখন রাসুল (সা.) বললেন, কথাগুলো আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হয়েছে। কারণ কথাগুলোর জন্য আসমানের দরজা খুলে দেওয়া হয়েছিল। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১২৪৫)

মহান আল্লাহ আমাদের বেশি আল্লাহু আকবার তথা তার মাহাত্ম্য বর্ণনা করার তাওফিক দান করুন।

BBS cable ad