পাঁচশ বছর ধরে অম্লান বাঘা শাহী মসজিদ

রাজশাহী জেলা সদর থেকে প্রায় ৪১ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে বাঘা উপজেলায় অবস্থিত বাঘা মসজিদ। বাংলাদেশে মুসলিম স্থাপত্যশৈলীর একটি অপূর্ব নিদর্শন এই বাঘা শাহী মসজিদ। শত প্রাকৃতিক বিপর্যয়েও ৫০০ বছর ধরে স্বগৌরবে চীর অম্লান হয়ে রয়েছে মসজিদটি। মসজিদটিতে এখনও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মুসল্লিরা আসেন সালাত আদায়, কবর জিয়ারত, মানত ও পরিদর্শনের জন্য। সমতল থেকে প্রায় ৮ থেকে ১০ ফুট উঁচু একটি বেদির ওপর নির্মিত এই মসজিদ। আঙিনা ঘিরে রয়েছে সীমানা প্রাচীর। উত্তর ও দক্ষিণ দিকে রয়েছে দুটি প্রবেশপথ। দু’পাশেই রয়েছে বিশাল দুটি ফটক। দক্ষিণ পাশের ফটকটি এখনো রয়েছে। সেখানেও কারুকাজ। তবে উত্তর পাশেরটির অবস্থা আর আগের মতো নেই। বাঘা বাজারের ভেতর দিয়ে চলে গেছে আন্তঃজেলা সড়ক। সেখান থেকে উত্তর দিকে মুখ ফেরালেই মসজিদের ১০টি গম্বুজের কয়েকটি দৃশ্যমান হয়। এরপর প্রধান ফটক থেকে এর নির্মাণশৈলী দর্শনার্থীদের টেনে নিয়ে যায় মসজিদের ভেতরে।
প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ইতিহাসতত্ত্ববিদেরা বলছেন, হোসেন শাহী বংশের প্রতিষ্ঠাতা আলাউদ্দিন শাহের পুত্র সুলতান নাসিরুদ্দিন নসরত শাহ এই মসজিদ নির্মাণ করেন। নির্মাণকাল আনুমানিক ১৫২৩-১৫২৪ খ্রিস্টাব্দ। ২৫৬ বিঘা জমির ওপর অবস্থিত বাঘা শাহী মসজিদটি বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ কর্তৃক সংরক্ষিত।
দীর্ঘদিন ধরে মসজিদের পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন বাঘার বিশিষ্ট সমাজসেবী ও আইনজীবী আবদুল হান্নান।
তিনিই জানান, ১৮৯৭ সালের এক ভূমিকম্পে স্থানীয় অন্যান্য ঐতিহাসিক ইমারতের সঙ্গে বাঘা শাহী মসজিদটিরও ক্ষতি হয়। ভেঙে পড়ে ওপরের ১০টি গম্বুজ। তারপর থেকে দীর্ঘদিন মসজিদের ভেতরটা পরিত্যক্ত ছিল। একসময় ভেতরে টিনের ছাপড়া তৈরি করে নামাজ চলত। পরে সেগুলো ধ্বংস হয়ে গেলে গম্বুজগুলো পুনর্নির্মিত হয়। ১৯৭৬ সালের ৩১ আগস্ট থেকে কাজ শুরু হয়, চলে ১৯৭৭ সালের জুলাই পর্যন্ত।
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সূত্রমতে, বাঘা মসজিদে মোট দশটি গম্বুজ রয়েছে। আর ছাদকে ধরে রাখার জন্য মসজিদের অভ্যন্তরে রয়েছে ছয়টি স্তম্ভ, প্রবেশের জন্য রয়েছে পাঁচটি দরজা। ভেতরে রয়েছে চারটি কারুকার্যখচিত মেহরাব।
বাঘা মসজিদের দৈর্ঘ্য ৭৫ ফুট, প্রস্থ ৪২ ফুট, উচ্চতা ২৪ ফুট ৬ ইঞ্চি। দেয়ালের পুরুত্ব ৮ ফুট, গম্বুজের ব্যাস ৪২ ফুট, উচ্চতা ১২ ফুট। চৌচালা গম্বুজের ব্যাস ২০ ফুট, উচ্চতা প্রায় ৩০ ফুট।
বাঘা মসজিদটিকে যে বিষয়টি অনন্যতা দিয়েছে তা হলো এর সর্বত্র সুনিপুণ নকশাদার টেরাকোটা। এসব টেরাকোটার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে আমগাছ, শাপলা ফুল, লতাপাতাসহ নানান প্রাকৃতিক কারুকার্য।
বাঘা মসজিদ নির্মাণে ফারসি স্থাপত্যশৈলীর প্রভাব রয়েছে। মসজিদের মাঝখানের দরজার ওপর ফার্সি ভাষায় লেখা একটি শিলালিপি পাওয়া গেছে। বাঘা শাহী মসজিদটি সম্পূর্ণ পোড়ামাটির ইট দিয়ে তৈরি করা। ইটগুলোর গাঁথুনি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে চুন সুরকি।
মসজিদটির প্রায় সবখানেই রয়েছে টেরাকোটার নকশা। কিছু কিছু জায়গায় নোনা ধরে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ২০০৭ সালে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ অনুরূপ নকশা প্রতিস্থাপন করেছে। সিরাজগঞ্জের টেরাকোটাশিল্পী মদন পাল কাজটি করেছিলেন। যারা আগের নকশা দেখেননি, মদন পালের নকশার সঙ্গে আগের নকশার পার্থক্য তারা বুঝতে পারবেন না।
শাহ বংশের ইতিহাস সূত্র থেকে জানা গেছে, সুলতান নাসিরুদ্দিন নসরত শাহ তার পিতা আলাউদ্দিন হুসাইন শাহ’র মতোই প্রজাদরদী শাসক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি স্থানীয় জনগণের পানীয় জলের সমস্যা দূর করার জন্য মসজিদের সামনেই নির্মাণ করেন প্রকাণ্ড একটি দীঘি, যা প্রায় ৫০ বিঘা জমি নিয়ে বিস্তৃত।
এই দীঘির চারপাশে রয়েছে নারিকেল গাছের সারি। প্রতিবছর শীতকালে অসংখ্য পরিযায়ী পাখি এখানে এসে আশ্রয় নেয়। তাদের কলকাকলিতে এই এলাকা মুখরিত হয়ে ওঠে।
মসজিদের পাশেই আছে জহর খাকী পীর নামে একজন ধর্মীয় প্রাজ্ঞ মানুষের মাজার। ১৯৯৭ সালে মাজারের পশ্চিম পাশে খনন করা হয়। তখন সেখানে মাটির নিচে পাওয়া যায় ৩০ ফুট বাই ২০ ফুট আয়তনের একটি বাঁধানো মহল পুকুর। পুকুরটি একটি সুড়ঙ্গপথ দিয়ে অন্দরমহলের সঙ্গে যুক্ত ছিল।
এছাড়াও বাঘা মসজিদটির সীমানার ভেতরে রয়েছে নারী মসজিদ, কবরের পার্শ্ববর্তী মসজিদ, মাজার মসজিদ, আউলিয়াদের মাজার, মূল দরগাহ শরিফ ও জাদুঘর।
৫০০ বছরের প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শন, অপরূপ কারুকার্য সংবলিত টেরাকোটার নকশা সবমিলিয়ে বাংলাদেশের প্রাচীন স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন এই বাঘা শাহী মসজিদটি। এই অনন্যতার কারণেই হয়ত বাংলাদেশের ৫০ টাকা ও ১০ টাকার স্মারক ডাকটিকিটেও স্থান মিলেছে বাঘা শাহী মসজিদটির। এখানে প্রতিবছর ঈদুল ফিতরের দিন থেকে ৩ দিন পর্যন্ত বাঘার মেলার আয়োজন করা হয়। প্রায় ৫০০ বছর ধরে চলছে এই ঐতিহ্যবাহী মেলা।
বাঘার স্থানীয় বাসিন্দা শাহানুর আলম বাবু ছোটবেলা থেকেই নামাজ পড়ছেন বাঘা শাহী মসজিদে। তিনি বলেন, মসজিদে বর্তমানে নামাজ পড়তে হলে সরকারি স্বাস্থ্যবিধি মেনে মাস্ক পরে প্রবেশ করতে হয়। খুব বেশি লোক এখন মসজিদে নামাজে আসতে পারে না। বর্তমানে এখানে নারী মসজিদটি বন্ধ রয়েছে, বন্ধ রয়েছে বৃহৎ আকারের মিলাদ, কাঙ্গালীভোজসহ বিভিন্ন কার্যক্রম।
মূলত পদাধিকার বলে বাঘা শাহী মসজিদ কমিটির সভাপতি হয়ে থাকেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার। এক্ষেত্রে এই প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী মসজিদের সংরক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকির বিষয়ে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে বাঘা মসজিদের উন্নয়ন কল্পে ওজুখানার নির্মাণকাজ চলছে। এছাড়াও এই মসজিদের উন্নয়নে বিভিন্ন প্রশাসনিক কার্যক্রম চালু রয়েছে। পদাধিকার বলে ইউএনও এই ঐতিহ্যবাহী মসজিদের সভাপতি হওয়ায় মসজিদের উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষনের সিদ্ধান্ত আমাকেই নিতে হয়।
কোভিড-১৯ পরিস্থিতির আলোকে তিনি বলেন, এখানে প্রতি জুম্মায় প্রায় ৩-৪ হাজার লোকের জনসমাগম হয়। অনেকেই এই দিনে সালাত আদায়, মানত করা, মাজার জিয়ারত কিংবা পরিদর্শনে আসেন। কিন্তু করোনার ভয়াবহতা দিন দিন বেড়ে যাওয়ায় ৯ এপ্রিল থেকে জনসমাগম এড়ানোর নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।
তিনি জানান, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী শুক্রবার জুম্মা ও তারাবির নামাজের জন্য ২০ জনের বেশি মসজিদে নামাজ পড়তে পারবেন না।